Sunday, May 19, 2019

অনিন্দ্য রায়




কসমোকবিতা ,কবিতার ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মাণ্ডের কবিতা

অনিন্দ্য রায়


“;আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ” আর তার মাঝখানে জেগে ওঠে গান, জেগে ওঠে কবিতা ।  আমি, মানুষ আর আমরা, মানুষেরা, হোমো সেপিয়ান্স, এই পৃথিবীবাসী। কী সম্পর্ক আমার সাথে এই ব্রহ্মাণ্ডের ? ওই যে সুদূর নীহারিকা, সে কে হয় আমার ?

এই প্রশ্ন আর এর উত্তরের সন্ধানে আমাদের দর্শন, বিজ্ঞান, কবিতা।  কবি, তিনি এই মহাবিশ্বের একজন, এই মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে নিজেকে খুঁজে পান, চিহ্নিত করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান এই অনন্তপ্রসারী কসমসে সংযুক্ত করে কবির চেতনা, সেইএকাত্মতা থেকে, বোধ থেকে,  খোঁজ থেকে তিনি লেখেন কবিতা, মহাজগৎ কথা, লেখেন কসমো কবিতা, অ্যাস্ট্রোপোয়েট্রি, ব্রহ্মাণ্ডচেতনার কবিতা।

কসমোলজি হল The study of the origin and development of  the physical universe considered as a totality of phenomena in time and space, আর অ্যাস্ট্রো কথাটির অর্থ হল নক্ষত্রসম্পর্কিত, গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণু যে কোনো মহাগাজতিক বস্তু এবং স্পেস, ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত কোনো কিছু। মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের অনুসন্ধিৎসা ও প্রকাশ তো বেশ প্রাচীন, বেদের সময় থেকেই কবিতা ও জ্যোতির্বিদ্যা অভিন্নতায় প্রকাশিত হয়েছে । বিজ্ঞান বিবৃত হয়েছে কবিতা, আবার কখনো জ্যোতির্বিজ্ঞানের উচ্চারণই কবিতা হয়ে উঠেছে। এবং এই প্রবণতা আমাদের সময়েও লক্ষ্য করা যায়। 
‘Cosmos: A Personal Voyage’, ধারাবাহিক টেলিভিশন অনুষ্টান আমেরিকায় Public Broadcasting Serviceএ সম্প্রচারিত হয় ১৯৮০সালে। পরিচালক Hugh Adrian Malone, উপস্থাপক স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান। এ নিয়ে সাগানের লেখা ‘কসমস’ বই হয়ে বেরোয়। এ এক মহাকাব্য, সৃষ্টিরহস্য, প্রাণ ও চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ, মানুষের ব্যবহারিক জীবন – সব মিলেমিশে সাগানের ভাষ্যে কবিতাময় হয়ে ওঠে ‘কসমস’। টিভি শো এবং বই – দুইই দারুণ জনপ্রিয় হয়, সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, তাঁর একাত্মতা। হ্যাঁ, ‘কসমস’ আমার কাছে এক মহাকাব্য।

১৯৮৫ সালের অগাস্টে Valentin Grigore ও Andrei Dorian Gheorghe কসমোপোয়েট্রি নিয়ে একটি বহুমুখী প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেন । প্রথম কাজ হিসেবে উল্কা বিষয়ক কবিতা ও প্রবাদ সংগ্রহের একটি লিফলেট ইংরেজিতে ১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির ব্রন্ডেনবার্বুগে আন্তর্জাতিক উল্কা সম্মেলনে প্রকাশ করেন। তাঁদের উদ্যোগে SARM (Romanian Society for Meteors and Astronomy)-এর ব্যবস্থাপনায়বিগত বছরগুলিতে কসমোকবিতা নিয়ে নানা কর্মকাণ্ড আমরা লক্ষ্য করেছি।  প্রতিবছর আন্তর্জাতিক কমসোকবিতা উৎসবের আয়োজন, সারা পৃথিবীর এই বিষয়ে উৎসাহীদের মধ্যে সংযোগসাধন,  বিভিন্ন ভাষায় কসমোকবিতার সংকলন প্রকাশ – ব্রহ্মাণ্ডকবিতাকে একটি কাব্যধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে SARM-এর প্রয়াস উল্লেখযোগ্য । Andrei Dorian Gheorghe-র কথায়



“Cosmopoetry is the art which re-creates poetry by using literarily heavenly elements.
Astropoetry (astronomical poetry) represents its main and elite part, as a fusion between
 "the queen of sciences" (astronomy) and "the queen of arts" (poetry), and is characterized by
the measure in which can serve to the popularization of astronomy.
Cosmopoetry can also include:
-Derivations from astropoetry: astro-photo-poetry (astronomical or atmospheric photos and verses
by the same author), astro-art-poetry (astronomical artworks and verses by the same author),
astropoetic dramas (shows on astronomical verses), astrofolk music
 (songs on astronomical verses), tourist astropoetry (based especially on trips
 to astronomical objectives or for observing heavenly phenomena), etc.
-Astrohumanism, a general term for essays on old poetry, mythology and other traditions of the
 Cosmos, works about sky lovers' spirituality, astro-humour, etc.
-Complementary sub-genres: Science Fiction and Fantasy cosmopoems with a
stronomical features, astronautic poetry, etc.
Moreover, cosmopoetry is a creative alliance of the sky lovers for showing that the people
are not only simple inhabitants of a fine planet, but also cosmic beings."
Astropoetry ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করেন Stuart Atkinson, Astropoetry তাঁর কাছে, “Poems about, and inspired
by, the amazing universe we live in” ।
হ্যাঁ, এই বিশ্ব, আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে থাকা মহাবিশ্ব কবিমনকে হাতছানি দিয়েছে বহুকাল ধরে।

“নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে;
এক-একবার মনে হচ্ছিলো আমার- আধো ঘুমের ভিতর হয়তো-
মাথার উপরে মশারি নেই আমার,
স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে!
কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো।
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো- আকাশে একতিল
ফাঁক ছিলো না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের
মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো ।”
                                         ( হাওয়ার রাত / জীবনানন্দ দাশ )
এমন আশ্চর্য ডাক, এমন আশ্চর্য সম্পর্কযাপন কবিতার সাথে মহাকাশের । মহাজাগতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে উৎসারিত হয় কবিতা, সেই প্রবাহেরই অংশ হয়ে ওঠে।
        ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন ।
        মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে এসেছে ।
        সন্ধেবেলা বার বার ঘরবার ক্রি, পুব আকাশে তাকাই –
        মঙ্গল কি উঠল ?
        একসময় সাতটা সাড়ে সাতটায় দেখি, রস্তার পাশের
        দেবদারুর মগডাল ছাড়িয়ে সে কখন উঠে বসে আছে ।
        মেঘ করেছে ।
        মাছির চোখের মতো তুচ্ছ আলো জ্বালিয়ে একটা প্লেন
        গোঁ গোঁ করে মেঘের ফাঁকে
        দমদমের দিকে উড়ে গেল ।
        মঙ্গল প্রেমের গানে রাঙা মুকুলের মতো দিনশেষে ফুটেছে, একলা,
        পাতলা মেঘ জলকণা দিয়ে তার রাগ আর নিঃসঙ্গতা মুছিয়ে দেয় ।
        আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছি
        সেই নিঃসঙ্গ যোদ্ধা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে পাঁচতলার কার্নিসের ওপারে
        চলে গেল ।
        আর কয়েকদিন তাকে ঐ রকম উজ্জ্বল দেখব,
        তারপর ক্ষীণ দেখব,
        তারপর আর দেখব না ।
        সে অথবা আমি, যে-কেউ একজন
        অনন্ত দূরে চলে গিয়েছি ।
            ( মঙ্গল / মণীন্দ্র গুপ্ত )
দূরে অনন্তে নক্ষত্র জেগে থাকে
        ....
অনন্ত নক্ষত্রবীথি – সামাধির দ্যোতনা তোমার বাহুতেও আছে
মেঘেও পায় না টের – নীলিমার গভীর আরাম
আমাদের কাছে
বোধ হয় – বোধের ওপারে
নিখিল তরণী ভেসে চলে একা মাঝিমাল্লাহীন
দিঙ্‌রেখা দুস্তর
অনন্ত নক্ষত্রবীথি – মধ্যে আছে তারই জন্মান্তর ।।
        ( অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকার / শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
তুমি, অন্ধকার, তোমার রূপ ও অরূপ, তোমার তরঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করেছে। ‘আঁধারতরঙ্গ’, একরাম আলির  কবিতার বইটি মহাবিশ্বের শূন্যতা ও অস্তিত্বকে কবিতাআঙ্গিকে ন্যারেট করেছে। ১২টি খণ্ড কবিতা, উৎসর্গপত্রের ১টি ও ১টি বিভাব কবিতা – একটিই মূল সুরে সম্পূর্ণ বইটি। 
        একদিন, আকাশ গুটিয়ে আসবে
        গ্রহ ও নক্ষত্রগুলির ভেতর থেকে বস্তুপুঞ্জ ছিটকে
        বেরিয়ে পড়বে সংকুচিত আকাশের দিকে দিকে
       
        সেদিনও পিঁপড়েটি সামান্য খাবার নিয়ে
        টেনে-হিঁচড়ে যেতে চাইবে ক্ষীণ গর্তের দিকে
        যেখানে এক গর্ভবতী পিঁপড়ে
        অমঙ্গল-আশঙ্কায় বসে বসে কাঁপছে
       
        আর, একা চুপচাপ শুনছে
        মাটির আরও আরও ভেতরের
        তামা, লোহা আর সোনার পরস্পরবিরোধী গর্জন
            [ উৎসর্গপত্র ( শ্রীময়ী ভৌমিক ও অনুরূপ ভৌমিক-কে/ একরাম আলি ]
ফিজিক্স তার ভেতরের কাব্যসম্ভাবনা নিয়ে ছড়িয়ে আছে বইটিতে।  কিন্তু তা কখনোই টেক্সটবুক হয়ে ওঠে না, প্রবন্ধ হয়ে ওঠে না। কবিতা যা ধারণ করে আছে ব্রহ্মান্ডভাবনাকে।
  মহাশূন্য মুলত নিঃশব্দ এক হিম অন্ধকার
          আলো, তার বিরুদ্ধে আপ্রাণ যায় বলে
               প্রতিবাদই চিরকাল মহাবিশ্বে নক্ষত্রের নীল সমাহার

        রাত্রির শূন্যতা আর দিনের শূন্যতা থেকে দূরে
        আলোক-শূন্যতা আর আঁধার-শূন্যতা গতিময়

        যাবতীয় নক্ষত্র, জ্যোতিষ্কপুঞ্জ অতি অল্প আলোক নিয়েও
        হাজার শতাব্দীদূর মহাঅন্ধকারের আকাশে
        প্রাণপণে প্রজ্বলিত হয়ে যেতে চায়
            ( প্রথম অংশ / আঁধার তরঙ্গ / একরাম আলি )

‘আলোর অপেরা’ কাব্যনাট্যে অনন্য রায় অনন্য হয়ে ওঠেন এই বিশ্ববীক্ষণে। অর্ণব, একটি চরিত্র, সেখানে বলে
“ ব্রহ্মাণ্ড এক জ্বলন্ত অ্যালজেব্রা; যার সিঁড়িংভাঙা অবরোহী প্রণালীর মাঝপথে তাকে থামিয়ে যদি-বা শূন্যতামেহ জিগ্যেস করে কেউ সে মায়াবী গণিতের স্রষ্টাকে : ‘ এর মানে কী হলো ? কেন যে এই অনাবশ্যক মায়ার খেলা?’ .... তবে রক্তমাংসের বাস্তবতার কূপমণ্ডুক-সীমানা ছাড়িয়ে কার্যকারণের অতীত ব্রহ্ম উত্তর দেবেন একটাই : ‘ শুধু অপেক্ষা করো ; অপেক্ষা করো তবু । দেখবে – শেষ পর্যন্ত মিলবে সবই।’( ds2 < 0 )
কসমোলজির প্রতি অনন্যর উৎসাহ আমরা দেখি তাঁর কবিতাকেন্দ্রকে। “মোটামুটি নানারকম নেশা করা, বই পড়া, পিউ-নাম্নী এক বালিকার সঙ্গে সহাস্য প্রেম করা এবং ক্রিকেট ও পদার্থবিদ্যা-বিষয়ে ভাবা। গান শোনা। এক লারেলাপ্পা একাকীত্বের কাছে নিজেকে উৎসর্গ কয়া । মৃত্যুর সঙ্গে খুচরো ইয়ার্কি।” তাঁরএই কথায় সেটুকু সিরিয়াস তা ঐ ‘পদার্থবিদ্যা-বিষয়ে ভাবা’।
জয় গোস্বামীর কবিতার বই ‘এক’ মহাবিশ্বধারণার অন্যতর উপস্থাপন। কথোপকথনধর্মী সূচনা ও উপসংহারের কবিতাসহ ‘এক’টিই কবিতা কয়েকটি অংশে বিভক্ত, যা সৃষ্টির সিংগুলারিটিই সূচিত করে।
         কানায় কানায় পাত্র টলমল করে তার কানা বা কিনারা কোথা যায়
         যায় ভেসে যায় ওই সন্তরণ ক’রে কত বড় ক্ষুদ্র ছোট
         বর্তুল বর্তুল পিণ্ড পেটে অগ্নিভরা সব কিরণে কিরণ স্বচ্ছ ঘোলা
         এই স্পষ্ট করে ওই চন্দ্রমেঘে ঢেকে ফেলে পূর্ণ বা অর্ধেক পুচ্ছপথ
    বাঁকা শুভ্র দাগ টেনে এই ভেসে উঠে ডুবে উঠে শুভ্র কুহেলী ঘুমালে
    পাত্রের তলায় শুয়ে আমি উর্দ্ধমুখে রই, জাগরণে আমার তলায়
    কানায় কানায় পাত্র টলমল করে চির কিনারা কিনারা ডুবে যায়
                         ( অন্তিম অংশ / এক / জয় গোস্বামী)
ব্রহ্মাণ্ড চেতনার পাশাপশি চেতনব্রহ্মাণ্ডের কবিতাও লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়, যা পদার্থবিজ্ঞানের ‘ফিজিক্যাল’ ব্রহ্মাণ্ড নয়, মেটাফিজিক্যাল; যা বস্তুগজৎ থেকে উৎপন্ন কিন্তু অধিবাস্তবিক।
        পেট্রলের গন্ধে চেনা যায় এই শহরের ঘুমন্ত ডানায়
        ফলিত নিশিবাতাস, কোথাও সবুজ নালিঘাসের
        মিউজিক নেই, আর শ্রেণী সংগ্রামের আঙ্গিক, শুধু
        মাথার ভিতর নীল আলোর কামড়, তীব্র সে কামড়ের পর
        এই সেই দলিল, মারীগুটিকা, মা-মরা শিশুর উড়ে যাওয়া,
        খোঁপার ভিতরকার ব্রহ্মাণ্ডে ঘন মেঘ, কিছুটা ক্লান্তি,

        তারপর রাত বেড়ে গেলে ঘুমন্ত ডানা ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে ।
        লাল পাউডার মেখে অগণিত গাছের মাথা, নিচে অতিরিক্ত
        খোলশ-কাহিনী । বেদনা এসে ধাক্কা মারছে ব’লে জন্ম নেয়
        লকলকে গানের টুকরো । একটা গান মুখে নিয়ে মহাশূন্যে
        মিশে যায় মসৃন বিড়াল । আর একটা গান লেগে থাকে
পুরুষ্ট আঁশবঁটির গায়ে । হিংস্র কিশোরীর মতো যে দুধ
উথ্‌লে উঠলো, সে দুধের সরে এই আছড়ানো শিল্প।
দরজায় কড়া নাড়বার শব্দে পুকুরভর্তি জলও নড়তে থাকে ;
পাত্‌লা ফিনফিনে, ভাসমান ডানা, গা ঝেড়ে উঠে আসে,
মেঘের শুঁড়, আমরা নিশ্চয় মনে রাখবো প্রৌঢ়াদের
মোটা চশমা, পায়ের ছাপ আর মৃত্যুটলমল এ –সব আলোচনা
                            ( ব্রহ্মাণ্ড / জহর সেনমজুমদার )
কবি খুঁজতে চান তাঁর উৎস, সৃষ্টির আদি সূত্রগুলি।
‘উৎসবীজ’ দেবাদাস আচার্য-র কবিতার বই, একটিই কবিতা।
সৃষ্টিকে, সৃষ্টির উৎসকে সন্ধান করেন কবি, আর তার ভেতরের যে হারমনি সেই কসমসে নিজের অবস্থান স্থির করেন।
        ....
ব্রহ্মার পদ্মনাভি থেকে উৎসারিত ওম্‌ ধ্বনি
        চমৎকার প্রতীকে সে রূপান্তর করে, শব্দ গড়ে,
        মহাজাগতিক মৌল ধূলিকণা ভেঙে গড়ে কোষ,
        শ্বসন ও উপচিতি তাকে দেয় বহমান প্রাণ
        প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে শক্তিঘর সূর্য-আলোকিত
        প্রতিটি শক্তির অণু ধরে আছে সংবেদন স্বর
        প্রতিটি অণুর উৎসেচকগুলি সুশৃখল, জ্যোতি
        বিভাসিত করে, এক আশ্চর্য প্রক্রিয়া থেকে প্রাণ
        আত্মায় আবিষ্ট হয়, মধ্যবর্তী রূপান্তর-কলা
        ছেদ-চিহ্নহীন, যার প্রিয় নাম অধিপ্রাণ, যার
        অভীগ আলোকবর্তী বিভা বিশ্বে প্রান্তনক্ষত্রের
        অভিকর্ষ স্পর্শ করে, অপার বিস্ময়ঘেরা গ্রহ,
        মায়া, অধিপ্রাণ, আত্মা, জ্যোতি-মধ্য-রেখার আবহ
        নিজস্ব ফোটন অণু এ বিশ্বে ছড়ায়, প্রসারণ,
        জৈব-সংকোচন হেতু আকাক্ষার বীজ নিয়ে ছোটে
        গ্রহান্তরে, পাঠায় সংকেত মহাপ্রাণের সন্ধানে ।

        আমি সূক্ষ্ণ, অতিজাগতিক
        চেতনার ধারাস্রোত থেকে
        ছিটকে আসে পরমাণু এক,
        রূপহীন, মায়া-কায়াহীন
        মৌল অণু, পৃথিবীতে এসে
        তার রসায়নে মিশে গেছি ।
        তার নিজ চেতনার স্রোতে
        বীজে ও আঙ্গিকে অন্তর্লীন
        ষড়রিপুময় হয়ে আছি ।
        ....
                ( অংশ / উৎসবীজ / দেবদাস আচার্য )
সম্পূর্ণ কবিতাটি আমাদের কসমিক চৈতন্যে প্রবেশ করায়, হ্যাঁ, কসমোকবিতার সার্থকতা স্পর্শ করে ।
আর এই মহাবিশ্ব তো একটি কবিতাই, একটি মহাকবিতা।
তারপর ঈশ্বর  বললেন, “আলো হোক” আর জ্বলে উঠল আলো।
ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন মহাশূন্য, বানালেন নেবুলা, নক্ষত্র, গ্রহ। উপগ্রহ ।
বানালেন পৃথিবী। আকাশ। বায়ু। জল ও অগ্নি।
পাহাড়, পর্বত, মহাসাগর, নদী।
বানালেন প্রাণ, তৃণ থেকে মহীরূহ, অ্যামিবা, মৎস, সরীসৃপ , পক্ষী, পশুকূল; বানালেন মানুষ।
মানুষকে দিলেন  ইশারা ও ভাষা, প্রেম ও হিংসা, যৌনতা, বিশ্বাস ও সন্দেহ, গণিত ও সঙ্গীত, বিজ্ঞান,  সাহিত্য,  চারু, কারু, অভিনয়, সকলকিছু।
সবকিছু।
ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন ।
তারপর সব শেষে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে এই রচনার দিকে তাকালেন। তাঁর মন ভরে গেল। তিনি নিজের হাতের দিকে তাকালেন। দেখুন যে, এতোক্ষণ তিনি যা কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন সেসবের চূর্ণ লেগে আছে তাঁর হাতে, আঙুলের ফাঁকে ।
তিনি হাত ঝেড়ে ফেলতে গেলেন।
তাঁর কেমন একটা মায়া হল।
তিনি তার হাতে লেগে থাকা সমস্ত কিছু, এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সমস্ত দিয়ে বানালেন কবিতা।



   
   





No comments:

Post a Comment

সূচীপত্র

সম্পাদকীয় দেহ্‌লিজের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ হলো অনুবাদ Agni Roy ...