অমল বসু
নাতনির সাথে ডেটিং-এ
১)
কলেজের
গেটে অপেক্ষা চিরকালই দাঁড়িয়ে থাকে। তেমনি দাঁড়িয়ে ছুঁতে চাইছি বেলা সাড়ে
তিনটের দূরত্ব।নবীন সময় আই কার্ড বুকে অর্জন করেছে আত্মবিশ্বাস। এই সময় কথা
শোনে না, সব অর্থেই অনিশ্চিতও নির্লিপ্ত। অটো টোটো কার বাস ট্যালা নারী
পুরুষ কুকুরও ছুটছে। বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষার ছায়া নেই। লম্বা বেঞ্চগুলোয়
বসে আছে শূন্যতা। সমস্যা সমাধানে পৌঁছে গেলেও জিরাফের লম্বা নজর ঝুলিয়ে
রাখি কলেজের গেটে। একই আদলের ছেলে ও মেয়েরা। নীলাভ জিন্স, পিঠে কালো ব্যাগ।
নিজের নাতনিকে আলাদা করে চেনাও জটিল অঙ্কের উত্তর খোঁজা। রঙের বিচারে
রামধনুর কাছে পৌঁছে গেলে, মনে পড়ে মেরুন রং সেখানে নেই। তবু না থাকা
রঙটিকেই খুঁজে নিয়ে ছিল তার ব্যাগ। ছুটিছাটায় বেড়াতে এলে তাকে স্কুলবাসে
তুলে দিতাম, শুভার্থী কেউ যদি প্রশ্ন করতেন, মাম্মি আয়ি নেহি? বাঁহাত
উল্টিয়ে শৈশব চিনিয়ে দিত, এহি মেরি মাম্মি। অপ্রস্তুত হাসি জড়িয়ে তিনি
বলতেন, নমস্তে আঙ্কেল।
দিন
গড়িয়ে ফার্স্ট ইয়ার এখন আমার অভিভাবক। দেশ বিদেশে কতবার ঠাঁইনাড়া হয়ে
বিশ্বনাগরিক দিল্লিতে। আজ শনিবার বেড়াতে যাবার কথা মিলিনিয়ম সিটিতে। ভাবনার
এক্সকেলেটর থেমে যায় হাসি খুশি দুটি চোখে। আমার হাত টেনে ধরে বলে, চলো।
তৎপরতার সাথে অটো দাঁড় করায়, আমাকে বসিয়ে সে ওঠে। দৃঢ় উচ্চারণে বলে,
মেট্রো। স্টেশন শব্দটি উহ্য থেকে গেলেও অটো বাঁক নিয়ে ছোটে। গোবিন্দপুরি
স্টেশনে চলমান সিঁড়ি গতিমগ্ন। আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ঝুঁকে বলে, পারবে
তো? বাধ্য শিশুর মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাই। একটা সিঁড়ি ওপরে দাঁড়িয়ে
আমার হাত ধরে থাকে। ল্যান্ডিং-এ নেমে এক পাশে সরে বলে, শোনো এ কলকাতা নয়।
সাত রঙের আটটা লাইনের বিস্তার। মাকড়শার জাল পাতা দিল্লি-মেট্রো, এদিক ওদিক
হলেই জড়িয়ে যাবে। এটা ভায়োলেট লাইন। নেক্সট ইজ কালকাজি, সেখানে নামব।
কালকাজিতে দুটো লাইন ভায়োলেট অ্যান্ড ম্যাজেন্টা। ম্যাজেন্টা লাইনে গিয়ে
হসখাস স্টেশন। সেখানে ইয়োলো লাইন ধরে যেতে হবে হুডা মেট্রো স্টেশন, বুঝলে?
ভায়োলেট ম্যাজেন্টা ইয়োলো রং গুলিয়ে কী রং হয়, জানা না থাকায় ডানে বাঁয়ে
মাথা দুলিয়ে তাকে অনুসরণ করি। টিকিটের স্বয়ংক্রিয় মেশিন, অনেকটা এটিএম-এর
মতো। স্ক্রিনে H ছুঁতে ড্রপডাউন মেনুতে হুডা মেট্রো স্টেশন। যাত্রী সংখ্যা,
টাচ1, এল 60.00, স্লটে 50 ও 10 টাকার নোট রাখতেই ব্যাঙের উল্টো জিভে সটাসট
গায়েব। গড়িয়ে এল কালচে রঙের একটা চাকতি। সেটা তুলে নিয়েই বললে, চলো। মুখ
তুলে তার চোখে প্রশ্ন রাখতেই বললে, আমার কার্ড আছে। সিকিউরিটি চেক সেরে
প্লাটফর্মে গিয়ে সে বলে, পায়ের নীচে এই ইয়োলো রঙের তীরগুলো গাড়িতে ওঠার
নির্দেশ। মাঝের বিপরীত মুখী মেরুন তীর ধরে নেমে আসবে যাত্রীরা। প্রশস্ত
দরজার মুখে নো ধাক্কা ধাক্কি। মজার হাসিতে বলল, এটাই মেট্রো ডিসিপ্লিন।
২)
ট্রেন
এসে দাঁড়ালে অভ্যাস মতো আমি যাত্রী নামার অপেক্ষায়। ওঃ! ভ্রূ কুঁচকে সে
দ্রুত আমাকে ট্রেনের ভেতরে টেনে নেয়। মুহূর্তেই ট্রেন কালকাজি মন্দির
স্টপেজে এসে দাঁড়ায়। দু-পাশে লোক উঠছে মাঝ বরাবর আমরা নেমে পড়ি। ম্যাম
প্রশ্ন করে, এবার কোন লাইন?
মাথা চুলকে ছাত্রের অনিশ্চিত উচ্চারণ, ম্যাজেন্টা!
-গুড।
দেখো ম্যাজেন্টা রঙের পায়ের ছাপ প্লাটফর্মে। আমি দেখি লক্ষ্মী সরস্বতী
কার্তিক গণেশের একমুখী মসৃণ পায়ের ছাপ নির্দিষ্ট অভিমুখে এগিয়ে গেছে। সেই
চলমান চিহ্ন পৌঁছে দিল রেললাইন আড়াল করা এক ধাতব দেয়ালের সামনে। সে চোখ
নাচিয়ে বলে, লুক আওয়ার নিউ টেকনোলজি। ডিপ্রেশনের মেঘ ঘন হলেই লাইনে ঝাঁপ
দেবার উপায় নেই।
-ঝাঁপ না হয় নাই দিলাম, কিন্তু ট্রেনে উঠব কী করে?
সে শরীর দুলিয়ে বলে, দেখতে থাকো কী করে কী হচ্ছে।
ট্রেন
প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালে দরজা বরাবর দেয়ালও দু-পাশে সরে গেল। ডিসিপ্লিন
মেনে ট্রেনে উঠে বসলে, কানের কাছে মুখ এনে বলে, টাইম জেনারেটস নিউ আইডিয়া।
পরক্ষণেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, লুক লোটাস টেম্পল। স্বচ্ছ জানালায় সাদা পদ্মের
অপরূপ স্থাপত্য অপসৃয়মাণ। ট্রেনের ভেতরে স্মার্ট ফোনের ডুবজলে তলিয়ে গেছে
অনেকেই। শিশুরাও খেলছে হাঁটু জলে। মেধাবী যাত্রীদের অবয়বে প্রসন্নতা। মাটি
থেকে অনেকটা ওপর দিয়ে ছুটছে ট্রেন। নাগরিক স্থাপত্যের বিস্তার ঘিরে আছে
সবুজ বনানী। মৃদু স্বরের যান্ত্রিক ঘোষণা নামিয়ে দেয় হসখাস স্টেশনে। তখনই
উল্টো দিকের ইয়োলো লাইনে ট্রেন ঢুকে পড়ে। সে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে
বলে, লিভ ইট। একরাশ ভীর ও ব্যস্ততা কুড়িয়ে নিয়ে ট্রেন চলে যায়। নাটকের
প্রম্পটারের স্বরে বলি, ঠিকই যেতে পারতাম। দু-চোখ কপালে তুলে, গোল ঠোঁটে ও ও
ও ... শব্দসুর ভাসিয়ে সে আমার দু-কাঁধে হাল্কা ঝাঁকি দিয়ে বলে, রিলাক্স
ম্যান।
কিছু
পরেই ট্রেন এলে উঠে বসি, ঝকঝকে রেক ফাঁকাই। মনোরম আলো ও এসি-র আরামে
যাত্রীরাও অন্যরকম। কলকাতার তুলনায় দিল্লি মেট্রোর ভাড়া অনেকটাই বেশি।
সাকেত স্টেশন এলে সে বলে, কুতুবমিনার দেখবে? কুতুবমিনারের সাথে তার সখ্যতার
খবর আমি শুনেছি। ন-বছর বয়সে ডেঙু, ভর্তি সাকেত ম্যাক্স হাসপাতালে। জানালায়
কুতুবমিনার ভুলিয়ে দিয়েছিল শারীরিক বিকার। অসময়ের কিছু আনন্দ চিহ্ন রেখে
গেছে আদুরে শৈশব। দু-পাশে পাহাড় ও অরণ্যের ল্যান্ডস্কেপে ছুটছি। সে বলে,
এটা গুরু দ্রোণাচার্য স্টেশন, আর দেরি নেই।
৩)
-বাঃ, তা আমরা কী খাব, কোথায় খাবো? কিছু ভেবেছো?
-শুধু
খাই খাই! অন্য কিছু ভাবতে পারো না? আমি তাজ্জব। সারাদিন কলেজ গেছে, খিদে
কি পায়নি? এ বয়স কীই না খায়, অথচ এ মেয়ে পহারীবাবা! আমাদের ছিল অনাদির
মোগলাই, ইনডিয়ানার চাপ তন্দুরি। বড়ো জোর আমিনিয়া স্পেশাল, রিয়ালের ফিরনি বা
কুলফি। মনের কথা মনে রেখে ঠোঁট উলটে বলি, খিদে পেয়েছে।
-বাড়ি
থেকে বেরুনোর সময় খেয়ে আসোনি? যাই বলা হবে, না করে বসবে। কী খাবে সেই
বলুক। সে নরম করে বললে, খুব খিদে পেয়েছে? আমি শিশুর মতো অকপট হাসি ছড়িয়ে
দক্ষিণি মাথা নাড়ি।
সে
বলে, ভেজরা অনেকেই চিকেন মাটান বিরিয়ানি সাঁটিয়ে বাড়ি ফিরে তুলসী পাতা
চিবোয়। সশব্দে হেসে হাতে মুখ ডাকে। কী সাংঘাতিক, আমাকে বেড়াল তপস্বী ভাবছে
নাকি! আমি বলি, আমার কোনো ছুৎমার্গ নেই, তুমি খেলে খাব।
-রাবিশ,
তুমি জানো না- আমি স্টেটস-এ থাকতেই ভেজ। এবার ভাবছি ভেগান হবো। বিরাট
কোহলি হয়েছে, জানো? ভেগান! এ মেয়ের কপালে কী লেখা আছে কে জানে? বলি,
পড়াশোনার সময়, কত পরিশ্রম, প্রোটিনের অভাব হবে যে!
-কেন, বিশ্বে কোন প্রাণী অন্য প্রাণির দুধ খায়, বলো?
- সে তাদের বুদ্ধি নেই বলে, পোষ মানাতে জানে না, তাই।
- এটা কুযুক্তি, তুমি ড. ক্যাম্বেলের চায়না স্টাডি পড়োনি?
- চিনেরা তো পোকা মাকড়ও ছাড়ে না, তার আবার স্টাডি?
- আমি যা জানি না, তা আর কেউ জানে, এ বুঝি হয় না?
আমি
অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি নবীনা নারীকে। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, দ্যাটস এ
গ্রেট রিসার্চ ওয়ার্ক অন ফুড হ্যাবিট এন্ড নিউট্রেশন। মিলিনিয়াম সিটি
গুড়গাঁও, গুরুগ্রাম নামে ছুঁতে চাইছে মহাভারতের সময়কে। দিল্লি-মেট্রোর
ইয়োলো লাইনের প্রান্তিক ঠিকানা হুডা মেট্রো স্টেশনে আমরা নামি। স্টেশনের
নীচেই মার্কেট। বারগার কিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে- বারগার খাবে তো?
লেটুসপাতা শসা গাজরের দৃশ্যটা হজম না হওয়ায় চোখ বুজি।
-তুমি
কি কেএফসির স্বপ্ন দেখছিলে? হাউ গ্রিডি ইয়ু আর! সে মিটি মিটি হাসছে। হয় তো
জরিপ করে দেখছে বৃদ্ধটি কতটা জেনুইন। নাকী তাকেই বিদ্রূপ করার সাহস
দেখাচ্ছে! সে হঠাৎ কপালে হাত নিয়ে বলে, দেব দ্বিজে ভক্তি অথচ ঘরে বাইরে
ভণ্ডামি কী করে করতে পারো তুমি? ভেগানের দরজায় পা বাড়িয়ে থাকা মেয়েকে
আশ্বস্ত করে বলি, আহা, ঘরে বাইরে আমি তো ভেজই, কিছু একটা হলেই হবে।
৪)
-তুমি কী জানো কিং মানে কী? রাজা বাদশা, মিনস- সেরা।
-ঠিক, তবে বার্গার টার্গার টিভিতে দেখে তো লেটুস পাতার কথাই মনে পড়ে।
সে
বার্গার কিং-এ ঢুকলে আমি তাকে অনুসরণ করি। নীল রঙের পোশাক পরা তরুণী হেসে
অভিবাদন করলে, সে এগিয়ে যায়, তাদের সংলাপ আমার কানে পৌঁছোয় না। কার্ডে দাম
মিটিয়ে পাশে এসে বলে, বার্গারের সাথে জলের বোতল বলে দিলাম, একটু ওয়েট করতে
হবে। কফি না কোল্ড ড্রিংকস, কী নেবে?
-কফিই বলে দাও।
-এখানে নয়, স্টারবাকসে কফি নেব।
-কফি খেতে আবার স্টারবাকস!
-যেখানে যা সেরা, স্পেশালাইজড দুনিয়া।
-ঠিকই, স্পেশাল মানুষদের জন্য সবই স্পেশাল।
-তুমি মজাক করছো?
-না,
দিদিভাই স্থান কাল পাত্রের ফারাকটা বুঝতে চেষ্টা করছি। কাউন্টারের ইঙ্গিত
পেয়ে সে এগিয়ে হাতে ধরে নিল খাবারে ট্রে। আমাকে চোখের ইশারায় জলের বোলত
নিতে বললে, নিলাম। পাশের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। অজস্র ছোট ছোট চেয়ার
টেবিল, ফাঁকাই। একজন খাবার শেষ করে ল্যাপটপ খুলে বসে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে
কিছু তরুণ তরুণী নিজেদের নিয়েই মগ্ন। দেয়াল ডানে রেখে একটা টেবিলে আমরা
মুখোমুখি বসি। ল্যাপটপ ছাড়া সবাই কথা বলছে, টের পাচ্ছে না বাতাস। আমার চোখ
এদিক ওদিক ঘুরেছে দেখে সে বলে, নো স্টকিং।
আমি বুঝতে না পেরে বলি, মানে!
সে ফিস ফিস করে বলে, কারো দিকে তাকিয়ে দেখতে নেই।
হেসে মাথা নেড়ে বলি, দিনাজপুরের হুদুই রয়ে গেলাম।
- ওঃ, সুইট ভিলেজ। আমার দেখা প্রথম গ্রাম, মুরারিপুর, নাইস। আরে, কাঁটা চামচ ধরেতে হবে না, হাত দিয়েই খাও।
- হাত দিয়ে! বেসিন কোথায়, হাত ধোব না?
সে
ট্রে থেকে টিসু পেপার তুলে নিয়ে হাসে, নো বেসিন। আমার ব্যাগে স্যানিটাইজার
আছে নেবে? স্যানিটাইজার লাগিয়ে টিসু পেপারে আঙুল ঘষে ঘষে বলি, নয়া দুনিয়া
নয়া জিন্দেগি। ভেজ বার্গারে টক নুন ঝাল মিষ্টির মিশ্রস্বাদের ক্রিমলেয়ার
বেশ উপাদেয়। স্বাদের মিষ্ট্রি, ভাবি এ বুঝি গ্রহান্তরের আমদানি। দাম কতো,
জানলে স্বাদের মাত্রা ছোঁয়া সহজ হয়। কিন্তু দাম জানতে চাওয়া মানে আর এক
বিপদ ডেকে আনা। তার মোবাইল-পাখি হঠাৎ অনুচ্চ স্বরে ডেকে উঠলে গলা নামিয়ে
বলে, হাই পাপা। ওপারের কথা শোনা যায় না
৫)
-হ্যাঁ, আমরা বার্গার কিং-এ।
-না তোমাকে আসতে হবে না, আমরা চলে যাব।
খেয়ে
দেয়ে টিসুপেপারে মুখ ও আঙুল মুছে উঠে দাঁড়াই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলি,
আর কফি খেয়ে কাজ নেই। সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, আফটার অল তুমি আমার
সম্মানীয় অতিথি। বদনাম হতে দেয়া যায় না, কী কফি নেবে?
-আমি ব্লাকই খাই, তবে আজ রেগুলার কফি বলে দাও।
-না,
বলছি ক্যাফিচিনো অথবা লাতে? ভাবি, ক্যাফিচিনো শব্দটা চেনা, লাতে! অগত্যা
নিরবতার বর্মে ঢুকে পড়ি। কফিশপে চেয়ার টেবিল প্রায় ফাঁকা শোফায় বসে বলি, কী
ব্যাপার, লোকজন কি নোটবন্দি হয়ে গেল?
-খানিক জিরিয়ে নিতে যারা আসে তারা একটু প্রাইভেসি চায়। এটা বুঝেই সময়ের দাম ধরে নিয়ে গলা কাটে কাস্টমারের। পুশিয়ে নেয়।
-খুব দামি বুঝি।
-সে তোমাকে ভাবতে হবে না।
-তুমি তো জব করো না, আমিই না হয় দিই। সে হেসে বলে, তুমি আমার গেস্ট। কী খাবে বলো? ক্যাফেচিনো স্ট্রং আর লাতে-তে দুধ বেশি থাকে।
-তবে ক্যাফেচিনো বলে দাও।
-আমি লাতে নেব, তোমাকেও টেস্ট করতে দেব, সে হাসে।
তার
দাঁতে সোনালি ব্রেসের ঝিলিক। আপেল কামড়ে খেতে পারত না। দাঁতগুলো কিছুটা
উঁচু দেখাত। ক-বছর ধরে চলছে ডেন্টিস্টের দরবারে যাতায়াত। কফি শেষ করে নীচে
রাস্তায় নেমে গেলে ছেঁকে ধরে অটো চালকেরা। গন্তব্য নির্বানার মার্কেট
এনক্লোজার ডেন্টিস্টের চেম্বার। অটোতে বসে মিহি কণ্ঠ বলে, এই হল আমাদের
দেশ। কফিশপের আলস্য নয়, প্রতি মুহূর্তের লড়াইয়ের মাঝে বেঁচে থাকে।
আমি
এক বিস্ময়ের মুখোমুখি। কী বললে, লড়াইয়ের মাঝে বেঁচে থাকে! সে মুখে কিছু
বলে না। তার ঘাড়ে থুতনি ও মাথা উঁচু নিচু হতে হতে থেমে যায়। আমি গলা খাদে
নামিয়ে বলি, কী করে লোকেট করো এই মহাভারতের সাথে?
-কেন? মেধা ও মননের সংযোগ হলেই তুমি পৌঁছে যেতে পারো অসম্ভবের কাছা কাছি।
তাকে
জড়িয়ে ধরে আদর করি। মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, কলেজের ওয়েলফেয়ার ক্যাম্পে এদিক
ওদিক যাচ্ছো বুঝি। সে বলে, কী যে বলো। চোখ কান খোলা থাকলেই হয়, চাই ইতিহাস
চেতনা। আলোর উৎসব দীপাবলি এবং হ্যালুইন-এর হাতছানি। প্রশস্ত চত্তরে দোকান
উপচে পড়া সম্ভার।
৬)
কালো
জমিনে সাদা কঙ্কাল আঁকা ভূতের আলখাল্লা ও মুখোশ। হিল ঠুকে দৌড়ে গিয়ে ভূতের
আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে সে হাসে। কী সুন্দর বলো! সুন্দরের রকম ফের নিশ্চয়
আছে, এও এক আনন্দ। আমাদের ছিল বুড়ির ঘর পোড়ানো, কী যে সেই উৎসাহের আয়োজন।
খাড়ির পাড়ে অপটু শৈশবে জড়ো করা যা কিছু দাহ্য। গোধূলির শেষে দাউদাউ জ্বলে
উঠত, পুড়ে যেত যাবতীয় ভয়। এই ভয় জয় করার রকম ফের হয় তো হ্যালুইন উদযাপন।
সে
বলে, জানো তো আমি তখন ক্লাস সিক্স। পোটোম্যাক নদীর পাড়ে আমাদের ফ্লাটের
উল্টো দিকে থাকত এক পাকিস্তানি পরিবার। তাদের মেয়ে জিয়া আমার সাথে কিলমার
স্কুলেই পড়তো। হ্যালুইনের সন্ধেতে ভূতের পোশাক ও মুখোশ পরে বন্ধুরা তাদের
দরজায় নকনক। জিয়ার মাম্মি দরজা খুলে দিলে দেখি সেও ভূত সেজেছে। আমাদের দেখে
লাফিয়ে উঠল। জিয়ার ফাদার চকলেট ক্যান্ডি দিল আর মাম্মি একশ ডলার। জিয়াকে
সঙ্গে নিয়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। দরজার ফ্রেমে জিয়ার পেরেন্টস হাত
নাড়ছে। দেশে ফিরে অন্য বন্ধুদের মতো জিয়ার সাথেও যোগাযোগ ছিল। ইদানীং আর
লিংক রাখি না। কী সব নজরদারি চালু হয়েছে। স্বদেশী ভূতেরা লিংক খুঁজে দরজায়
নকনক করলেই গেছি।
রোদ
মাখা সোনাঝুরি মুখে কী এক বিষণ্ণতা খুঁজে পাই। দৃষ্টি স্থির করলে তার চোখে
পলক পড়ে। রাজধানীর বৈভব ও ক্ষমতামগ্ন সময়কে ভেদ করে কোনো বার্তা কি পৌঁছে
গেছে যৌবনের দোরগোড়ায়? অথবা এ নেহাতই উড়ো মেঘের বিভ্রম। দোকান থেকে একটা
মুখোশ তুলে নিয়ে ছুটে আসে আমার দিকে। আমাকে পরিয়েই ছাড়ল হ্যালুইনের
ভূতমুখোশ। আর সে নিজে আপাদমস্তক ভূতের পোশাকে নাচানাচি শুরু করল। হয় তো
এভাবেই ভুলে যেতে চাইল বন্ধু জিয়াকে। আলখাল্লা পরেই ডেন্টিস্টের মুখোমুখি
চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল পাগলি মেয়ে। খানিক পরে মা ও বাবার সাথে ডাক্তারের
চেম্বার ছেড়ে সে লনে নেমে আসে। আকাশে দু-হাত তুলে উল্লাসে নেচে ওঠে।
হ্যালুইনের আলখাল্লা পরা একটি মেয়েকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই ফিরে
তাকায়। আমি দেখি ব্রেসমুক্ত দাঁতের উজ্জ্বল হাসি। সে বন্ধন মুক্তির খুশিতে
প্রায় কেঁদে ফেলে। এতো বছর পরে আমি দাঁত দিয়ে ভাঙতে পারব কাঠবাদাম।
মুরারিপুরে গেলে চিবিয়ে খেতে পারব আখ। শরীরের জন্য দাঁত, দেশের জন্য
গণতন্ত্র। সযত্নে রক্ষা করতে হবে দুটোই।
No comments:
Post a Comment