Sunday, May 19, 2019

নভেরা হোসেন

 

মন খারাপ

নভেরা হোসেন


বহুদিন ধরে তোমার মন খারাপ
আগে রাতে ঘুম না হলে
সারারাত জানালা দিয়ে আকাশ দেখা
নয়তো গভীর সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে
অন্য কোনো পৃথিবীতে
অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে
সেখানে মাছ আর পাখিরা আকাশে  খেলা করে

এখন শুধুই ওষুধের কৌটা খোঁজা
সারাদিন পথে পথে হেঁটে
সারারাত নির্ঘুম 
তবু তোমার মন খারাপ কাটেনা
বিষাদ সিন্ধু শেষ করে ডলু নদীর হাওয়া , 
শহীদুল জহির এখন নৌকাতে
তারও ভীষণ মন খারাপ
আগে মন খারাপ হলে  মরে  যেতে ইচ্ছে করতো
এখন কেন  মরে  যাবে সেজন্য মন খারাপ
শহীদুল জহির পুরান ঢাকার ডালপট্টিতে
সেখানে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ , ফরিদ কবির চা খাচ্ছে
সৈয়দ  তারিককেও দেখা যাচ্ছে মালিবাগ রেল লাইনের  দিকে
তখন ছেলেরা পেথেডিন নিতো
আর ডাইল খেয়ে কড়া  চিনি দিয়ে চা খেত
এখনো এসব চলে তবে বেশি চলে ইয়াবা
পাবলিক - লাইব্রেরির চিপায় লাইন লেগে থাকতো
একজন বের হলে অন্যজন
ম্যাক্স খেয়ে কয়েকজন চোখে সব উল্টা দেখতো
এসব ভাবতে ভাবতে তুমি মন খারাপের রাজ্য থেকে
বেরিয়ে বসুন্ধরা শপিং মল
সেখানে ফুডকোর্টে মেক্সিকান ফুড , লেবানিজ শর্মা
এসব খেতে খেতে ক্লান্ত  হয়ে গেলে
ঘুরতে ঘুরতে বইমেলা
সেখানে ঔপন্যাসিক মাসরুর আরেফিন
সে লিখেছে আগস্ট আবছায়া
লোকজন ভাবছে শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা বই
মাসরুর যতই বলছে এর মধ্যে আছে ফুয়েন্তেস , মার্কেজ , বোর্হেস
ট্যাক্সি ড্রাইভার আয়ার যে চব্বিশ  ঘন্টার মধ্যে দুই ঘন্টা ঘুমায়
কে কার কথা শোনে -
মাথায় একবার কিছু ঢুকে গেলে সিলগালা হয়ে  যায়
একবার আর্ট কলেজের লিটু বলেছিলো
ভাল্লাগেনাও আর ভাল্লাগে না
তুমি ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিলে শিনার মাংস
ইলেক্ট্রিক্যাল ওভেনে বার্বিকিউ হবে
সাথে পার্সলি  পাতার সালাদ
যদিও রেড মিট বহুদিন নিষেধ
কিন্তু কে যেন বলেছিলো
ওসব ফালতু কথা
সারা জীবন জিরোক্যাল খেয়ে
শেষে লিভার সিরোসিস হয়ে সব শেষ
ফান  -টান  করে দিনগুলো পার করে দাও
শামীম কবীর চব্বিশে   ভাবলো নাথিংনেসের কথা
এখন ওর বন্ধুরা রোজ সকালে ভদকায়  ডুবিয়ে বনরুটি খায়
আর একেকজন কচ্ছপের মতো আয়ু নিয়ে
ঘাপটি মেরে আছে সুড়ঙ্গের ভেতর 
এখানে সবার পথ আলাদা
কেউ সুতা দিয়ে কাঠ কাটছে
কেউ প্রেমিকের মাথায় কাঁটার  মুকুট পড়িয়ে উড়াচ্ছে নারীবাদের ঝান্ডা
কতোকাল পর বরফ গলা নদী-
মাহমুদ এখনো স্বপ্ন দেখে
একদিন বিপ্লব  আসবে
যারা কুকুরের মতো দালান চাপা পরে মারা গেলো
তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ  নেবে সময়
কালের নিয়তি নয় যেন এক প্রকান্ড ঝড়
দুমড়ে -মুচড়ে দেবে  সভ্যতার   হিংস্র দাঁত
হাজার হাজার বছর ধরে তৈরী হয়েছে  যে লাঞ্ছনার   ঘেঁটো
তা কখনো চিরকাল রয়ে যেতে পারে না
একজন মানুষ দিনে দু -ঘন্টা ঘুমিয়ে
কেমন করে বেঁচে থাকে ?
জীবনানন্দ দাসও আর এই বাংলায় ফিরতে চান না
যেখানে শুধুই ভাগাড়
শিকের উল্টো পাশে গাঁথা মানুষ

পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মারাও কখনো ফিরে আসতে চায় না
এই  জল্লাদখানায়  -
মানুষ যুদ্ধ  করে কখনো স্বাধীনতার জন্য
কখনো খাবারের  জন্য
কখনো তেলের জন্য
তুমি আজ কোন বদ্ধভূমিতে ?
ওখানে কি নীল স্থল-পদ্ম ফোঁটে
তোমার মন খারাপের কি কোনো শেষ আছে
বসন্তের বাতাস বইছে চারপাশে
সেখানেও একরাশ   ধুলো এসে
তোমার চোখকে ঢেকে দিলো
যা কিছু সত্য তুমি আর তা দেখতে চাও না
একটা ত্রিশঙ্কু ভঙ্গি
এই কি  বাস্তবের   অপর   নাম ?



পোকা


পোকার জীবন
একটা দুটো পাতা উড়ে যায়
হাতে বলিরেখা
চৈত্রের বৃষ্টিতে তোমার মন উন্মনা
পুরানো দিনের কথা ভাবছো
প্রেমিকের আদ্র চোখ
দীঘির জলে তৃতীয় নয়ন
যখন জানতে পারলে সব শূন্য
তখনও অবিরল বর্ষার জল
জীবনটা বেশ পদ্যময় ছিল
দিন দিন জটিল প্রবন্ধে পরিণত হলো
এখন কেউ এসব নিয়ে ভাবে না
ভালো একটা চাকরি , আধুনিক ফ্ল্যাট , প্রিমিও গাড়ি
উইকেন্ডে নতুন রেস্তোরাঁ , বছর শেষে য়ুরোপের ডায়েরি
এখন আমরা বেশ আন্তর্জাতিক হয়ে গেছি
ইচ্ছে করলেই ইন্ডিয়া , নেপাল , ইতালি 
পাতায়া সমুদ্রের পাড়
ডিনারে সি ফুড ,  লিকার
তোমার টেস্ট বদলে গেছে
কবিতা এখন পানসে লাগে
ট্যাবে দু একটা স্ট্যাটাস পড়ে ঘুমাতে যাও
ঘুমের মধ্যে শৈবাল হ্রদ , মঙ্গলের গিরিখাদ
শহরটা বেশ ঝকঝকে হয়ে উঠছে
সন্ধ্যার পর রেস্তোরাঁর আলো জ্বলতে শুরু করে
পানশালায় লোকের ভিড়
 হিজাব পড়া  নারীরা গাড়ি চালাচ্ছে
আরবীয় সংস্কৃতি তোমার ঘরে
শর্মা তোমার প্রিয় খাদ্য , পাস্তা  , গ্রিল চিকেন.. 
কেউ যেমন সারারাত বোমা বানিয়ে কাটাচ্ছে
অনেকে ছবি এঁকে
অনেকে তজবি গুনে
একেই বলে ইকুইলিব্রিয়াম
ওয়াইনের সাথে আরবীয় বাদাম
মাছের সাথে মেক্সিকান রুটি
দিন দিন তুমি সর্ববাদী হয়ে উঠছে
তোমার শরীর আজ পোকার অভয়স্হল  





পার্টিশান


তোমাকে বহুদিন দেখি না
সেবারে যখন মন্বন্তর দেখা দিলো
তখন তুমি বেশ তাগড়া জোয়ান
জাপানে বোমা পড়লো
আর চালের দাম বাড়লো
ব্রাহ্মণরা পর্যন্ত আধপেটা খেয়ে
ওলাওঠা গ্রামকে গ্রাম ধ্বংস করে দিলো
তারপর কেমন কেমন করে যুদ্ধ থেমে গেলো
বড় বড় সব চুক্তি হলো
এদেশের সীমানা ওদেশের হয়ে গেলো
অবরোধ চললো বহুদিন
একটা আস্ত দেশ ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেলো ..
নেতারা চাইলো রক্তপাতহীন পার্টিশান
হলো তার উল্টোটা
দলে দলে হিন্দুর গলা কাটলো মুসলমানেরা
আর মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বয়ে গেলো
পেশোয়ার এক্সপ্রেস ফিরে এলো লাশের মিছিল নিয়ে
এসব এখন গবেষণার বিষয়বস্তু
বুদ্ধিজীবীরা দেশভাগের নাড়ি-নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা করছেন
সাব-অল্টার্নরা এতো রক্তপাতের কারণ খুঁজছেন
এসব তো গেলো অনেক আগের কথা
তারপর ২৬ মার্চ , স্বাধীনতা ঘোষণা
আবারো শত শত হত্যাকাণ্ড, রক্তের বন্যা ...
ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্ষমতা এখন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত
এখন তো নতুন নতুন কথা হচ্ছে
ডিজিটাল বাংলাদেশ, রোবটের দুনিয়া
তুমি তার মধ্যেও অগ্রহায়ণের ভোরে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে ক্ষেতে যাচ্ছ
সেখানে নতুন ধান কাটা শেষে আলু বুনছো
হাতের আঙুলে কড়া পড়ে গেছে
তোমারও স্মার্ট কার্ড হয়েছে
চোখের আইরিশ দেখে বলে দেয়া যাবে তুমি জঙ্গি না ফেরারি
এখন তোমার বয়স হয়েছে
চোখে ভালো দেখতে পাও না
হাতে লাঠি নিয়ে বাড়ির দাওয়ায় দিন-রাত বসে থাকো
পুকুরের ধারে বকুল গাছ থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসে
ইচ্ছে করে পাখির মতো ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতে
এখন আর সারসের দেখা পাওয়া যায় না
তুমিও নিজের জন্য মাটি খুঁড়ছো
তিন হাত জমি খোঁড়া কত যে কঠিন !



No comments:

Post a Comment

সূচীপত্র

সম্পাদকীয় দেহ্‌লিজের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ হলো অনুবাদ Agni Roy ...