Sunday, May 19, 2019

গৌতম দাশ


অলোকেশ এবং হারিয়ে যাওয়া 


গৌতম দাশ

ইতিহাস জানেনি সব কিছু, কারণ তুমি পুস্তক লিখেছিলে,

সকাল থেকেই মাথায় লাইনটা সময়ের কাটার মতো
টিকটিক করে বেজে চলেছে, কিন্তু কিছুতেই অলোকেশের মনে
পড়ছে না কোথায় বা কবে সে লাইনটা পড়েছিল
আজকাল প্রায়ই এমন হয়, টুকরো লাইন, মুঠো ভাবনা,
মরচে ধরা স্মৃতি, টুকি দিয়েই তারা যেন হারিয়ে যায় বিস্মৃতির
আড়ালে, এই সব গুরুগম্ভীর ভাবনা অলোকেশের মাথায় যখন
কিলবিল করছিল রুপু তখন তাকে কাগজটা দিয়ে বলে ......

রুপু হচ্ছে সৌরভের বৌ আর সৌরভ তাদের প্রথম সন্তান,
ছেলের বিয়ের আগে বিভা অবশ্য এই সম্পর্ক নিয়ে
খুব একটা সহমত ছিল না, থমথমে মুখ নিয়ে সে
অলোকেশকে বলেছিল, শেষ অবধি কি না
পাঞ্জাবী মেয়ে! বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব পড়লো!
শুধু তাই নয়, রুপুর বলা নমস্কারকে উদ্ধৃত করে গিন্নী এটাও
বলেছিলেন, আহা! কথার ছিরি দেখো, নমস্কারকে
বলে কি না নোমস্কার্, রুপুর কথা থেকে অনেকদিন আগেই
অকারণের ও আর হসন্তকারগুলি মুছে গিয়েছে, অনেকদিন হলো
সে বাঙালীদের মত শাড়ি পরাও শিখে নিয়েছে, শাশুড়ির
থেকে শেখা শুক্ত খাইয়ে সে ইতিমধ্যেই আত্মীয়স্বজনকে
বার কয়েক অবাক করে দিয়েছে, আজকাল
বিভাও প্রায়ই বলে, রুপু হচ্ছে গিয়ে তাদের মেয়ে,
অলোকেশ কিন্তু কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চায় না,
না, শিউলির জায়গায় অন্য কাউকে
স্বীকার করে নিতে তার কোনো গোঁড়ামি নেই, আসলে
সে ভয় পায়, রুপুও যদি শিউলির মত হারিয়ে যায়

জিনিসপত্র মাত্র কয়েকটাই তবু রুপু তা ফর্দ করে দিয়েছে,

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!

যতীনের দোকানে বড় অকারণের ভিড় যেন, গুড়ের বস্তার
ওপর মাছিরা যেমন ভনভন করে, ঐ দুটো মেয়েমানুষ
যারা কি না এ পাড়ার অনেক বাড়িতে বাসনকোসন মাজে,
তারা চাল ডাল কেনার ফাঁকে তাদের দেহ সম্ভারের বেশ কিছুটা
উন্মুক্ত করে এসে দাঁড়িয়েছে দোকানে, আর তাদের সেই
দেহ সম্ভার দেখার লোভে রিকশাওয়ালা পল্টু
স স করে কথা বলা হাতকাটা শিবু আর উলটোদিকের
বাড়ির সদ্য রিটায়ার করা বংশীবাবু জিনিসপত্র কেনার ছুতোয়
এখন যেন ভনভন করছেন যতীনের দোকানে, অলোকেশ
গলায় একটা অকারনে খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
ফর্দটা ধরো যতীন, আমি একটু ঘুরে আসছি, তারপর হঠাৎ
যেন কি মনে পড়ে যাওয়াতে দু পা এগিয়েও সে ফিরে আসে,
যতীন, অলোকেশের গলাটা এখন বেশ গম্ভীর, দোকানের
ভিড়টাকে তিনি যেন বোঝাতে চাইছেন, বংশীবাবুদের মত
তার কোনো চৌম্বকীয় আকর্ষণ হচ্ছে না, নেহাতই
কথাটা বলা দরকার, তাই এই ফিরে আসা,
লেখাটা পড়তে পারবে তো, ছ্যাঃর, ও নিয়ে আপনি
চিন্তা করবেন-নি, ভুলো আছে না, ওকে দিয়ে পড়িয়ে নেবখন,
ভুলো কে, তা অবশ্য অলোকেশের চট করে মনে পরে না,
আজকাল প্রায়ই এমন হয়, মনের পর্দায় মাঝে-মাঝেই
স্মৃতিরা যেন ডুবো জাহাজের মত ভেসে ওঠে, আবার তা মিলিয়েও
যায়, সময় অসময়ে চেনা মুখ যেন বড় অচেনা হয়ে ওঠে

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!

বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দুটো কাজ নিয়ে বেড়িয়েছিল অলোকেশ
দ্বিতীয় কাজটা কিছুতেই মনে পড়ছে না, বিদ্যুৎ চলে গেলে
অন্ধকার যেমন প্রথমে বড় গাঢ়
লাগে অলোকেশের স্মৃতি জুড়েও সেরকম অন্ধকার যেন এখন,
রাস্তার ধারের মন্দিরটার সামনে দাঁড়িয়ে সে
কিছুক্ষণ ভাবলো কাজটা কি বিভার পুজো
সম্পর্কিত, তারপর সবজীওয়ালার ঠেলার
সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলো রুপু
তাকে কোনো সবজী নিয়ে যেতে বলেছে কি না, পোস্টঅফিস,
ইলেকট্রিক অফিস, টেলিফোন, ব্যাঙ্ক, এসবরে সামনে
দাড়িয়েও যখন কাজটা কিছুতেই মনে পড়লো না, তখন সে
রাস্তার দু’ধারের সারি সারি দোকান আর দেওয়ালে লাগানো
নানা রকম পোষ্টার দেখে শেষ একবার চেষ্টা করলো

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!


চারমাথার ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা অলোকেশকে
দেখে এখন যে কেউ মনে করতে পারে যে লোকটা হয়
কোনো ট্রাফিক ইন্সপেক্টর অথবা কোনো পাগল, সিগন্যালের
লাল-হলুদ-সবুজ আলোয় অনেকক্ষণ ধরে সে মনের সব
খানাখন্দগুলো খুঁজে বেড়ালো, যদি কাজটা মনে পরে ...... আর শেষ অবধি
মনে করতে না পেরে সময় দেখার জন্য বুকপকেট
থেকে সে খুব সাবধানে পকেটঘড়িটা
তুলে করলো, ঘড়িটা দশম বিবাহ বার্ষিকীতে বিভা তাকে
উপহার দিয়েছিল, ইস্, বারোটা চল্লিশ, শিউলিকে নিয়ে আজ তার খয়েরিটোলায়
যাওয়ার কথা, ইন্টারভিউ আছে মেয়েটার,
অলোকেশ তাড়াতাড়ি করে রাস্তার পাশের এস টি ডি বুথটায়
বাড়ির নম্বর ডায়াল করতে থাকে, ২ ৪ ৬ ৭, তারপর,
তারপর কি যেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, আরেকটা চার, অলোকেশ ভাবে
বাইরে বসা ছেলেটাকে ডেকে একবার জিজ্ঞাসা করবে কি না
কোলকাতার টেলিফোন নম্বরে আজকাল কতগুলো সংখ্যা
ডায়াল করতে হয়, সৌরভ বা রুপুর সঙ্গে
কথা বলার সময় তো ওদের বিদেশের নম্বরে
এগারোটা সংখ্যা ডায়াল করলেই হয়, ফোনটা বাজছে,
তরুণী কণ্ঠে কেউ যেন হ্যালো বলে উঠলো, কিন্তু
মেয়েটার গলা তো শিউলির মত নয়, আর তখনই অলোকেশের
হঠাৎ করে ছোটবেলাকার ভুলে যাওয়া পড়া মনে করার মত করে
মনে পরে গেলো, শিউলি তো সেদিন আর ইন্টারভিউ দিয়ে
বাড়ি ফেরেনি, বাসটা ওকে একদম পিষে দিয়ে গিয়েছিল

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!

বেশ খিধে খিধে পাচ্ছে অলোকেশের এখন, খিধেটা অবশ্য
পাওয়ারই কথা, সেই সকালবেলায় দুটো লুচি আর আলু চচ্চড়ি
খেয়ে বেড়িয়েছিল, মনুর মা লুচির প্লেটটা দিতে দিতে বলেছিল,
বাবু, তেল কিন্তু ফুইরে গ্যাছে, আনতে হবে, মনে
কইরে কথাটা কাগজে লিইখ্যা নেন, আপনি তো আবার আইজকাল
সব কিছু ভুইলা যান, আর একখান কথা,
এই বয়সে রোজ রোজ আর অত নুচি-পরোটা খাবেন-নি গো,
মনুর মা যখন এই কথাগুলি বলছিল তখন তার মুখের দিকে
তাকিয়ে অলোকেশের মনে হলো চারটে চালচিত্র যেন
সেখানে আঁকা , মা, বিভা, শিউলি আর রুপু,
অলোকেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে সেদিনের সেই হোটেলটা
খুঁজে বেড়ায়, বিয়ের পর অফিস ছুটি নিয়ে শহরটায়
এলোপাথাড়ি ঘুরবে বলে যেদিন সে বিভাকে নিয়ে
বেড়িয়েছিল সেদিন তারা এই হোটেলটাতেই দুপুরে
ভাত খেয়েছিল, কলাপাতায় ধোঁয়া উঠতে
থাকা ভাত, সঙ্গে বাটা মাছের ঝাল, ভুল করে
কাঁচা লংকা খেয়ে বিভার সে কি হাঁসফাঁস, না,
আজ মনে করে একটা জলের বোতল রাখতে হবে সঙ্গে,
বিভা আবার সব জায়গার জল খেতে পারে না, কিন্তু হোটেলটা
কোথায় গেলো, কুমুদরঞ্জন লেনের ঠিক মুখেই তো ছিল,
অলোকেশ হঠাৎ খেয়াল হলো, এই রাস্তাটার নাম যেন
অন্য কিছু, তাহলে কি কুমুদরঞ্জন লেনটাও হারিয়ে গেলো বিভার মতই,

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!

এক পশলা বৃষ্টি শেষে বেলা এখন শেষবেলার পথে
মানুষ চলেছে ঘরের পথে, শহরের বুকে নেমে আসছে
আদুরে সন্ধ্যা, রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠছে নিয়নের আলো,
এই শহরটাও যেন আজ বিভার মতই বিকেলে গা ধুয়ে
পাটভাঙা শাড়ি পরে কুমকুম পাউডারে নিজেকে
সাজিয়ে নিচ্ছে, না, অলোকেশ আর হাঁটতে পারছে না,
পা দুটো তার বড় ক্লান্ত, শরীর জুড়ে যেন এক ধূসর অবসন্নতা,
এই শহরটায় আজ সে একের পর এক রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছে, কিন্তু
বেলা শেষে তার মনে পড়ছে না বাড়ি ফেরার রাস্তাটা, চারমাথার
অনেকগুলো মোড়ে এসে সে ভেবেছে এই মোড়টা থেকে
বাঁদিকে বেকলেই যতীনের দোকান, কিন্তু
একটা বাঁদিকের মোড়েও যতীনের দোকান খুঁজে না পেয়ে
সে এখন যেন বড় উদ্দেশ্যহীন, শিউলি, বিভা
সৌরভ, রুপু, সবাই এক-এককরে তার পথ চলার সাথী হচ্ছে
চলার পথে ভিড় বাড়ছে স্মৃতির মিছিল,

হেঁটে যাচ্ছে তারা সবাই, কখনো একসাথে, কখনো বা একা-একা

ইতিহাস জানেনি সবকিছু, কারণ তুমি পুস্তক লিখেছিলে

সকালের সেই লাইনটা আবার অলোকেশের মাথায় যেন টিকটিক করে বেজে ওঠে

ইতিহাস না হয় না-ই বা লেখা হলো, অলোকেশ তবু এই ভাবেই হেঁটে যেতে চায়,

কতগুলো মুখ আর কিছু স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে

আজকাল যে কি হয়েছে হায়, সবকিছু বড় ভুল হয়ে যায়!

2 comments:

সূচীপত্র

সম্পাদকীয় দেহ্‌লিজের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ হলো অনুবাদ Agni Roy ...