Sunday, May 19, 2019

দিলীপ ফৌজদার

 

স্মৃতিরিক্ত বাণপ্রস্থের  এই খসড়ায়

দিলীপ ফৌজদার



বাণপ্রস্থের  কথা আসতেই তো 
খুলে  গেল তোরঙ্গের ডালা
না , জং ধরেনি একরাশ ন্যাপথলিনের গন্ধ
পুরোনো ম্যাগনেটিক টেপের ক্যাসেটে
বিবর্ণ এ্যালবামে থম  মারা ছবিরা
আর অগোছালো চিরকুটগুলিতে
জমিয়ে রাখা  টুকিটাকিতে  নানান
অজস্র  সংবাদ।

নিজেকে দেখার কত প্রক্রিয়া--
একটা তো নিজেকে সরিয়ে রাখা 
দরজাহীন কুঠুরিতে  কিম্বা শামুকের খোলে
অথবা অবিশ্বাস্য নগরযাপনেও

কেউ জানে না কখন বাসে উঠি কখন  নেমে  যাই

কেউ জানে না কেন কথা রাখি না
দেখা করার অঙ্গীকার  ভেঙ্গে
রেস্তোরাঁর  মুখ  থেকে ফিরে গেছি কতবার
কতবার কতজনের বসার  ঘর  থেকে উঠে এসেছি আর ওমুখো  হই নি
যে আচরণের একটাতেও অসম্মান ছিল না
সব আয়নাতেই নিজেকে  দেখতে চেয়েছি
আয়না গুলোয় আঁটে নি চেহারা
আয়নাগুলো তোলে নি  চেহারা
ক্ষোভ নেই     হতাশাও  নেই
তুমি যতবার  ফিরিয়ে দিয়েছ বা পিঠ  ফিরিয়েছ

ভালোবাসা  নেই ভেবে নিয়ে রাতের ঘুম হারাই নি  ভালোবাসা আপনাআপনিই এসেছে_ _
ছেড়ে যায়নি কখনই

শুধু সময়টা ধরা থাকে  নি 
আর তোমাকে কতবার ফিরিয়ে দিলাম
একবার, দুবার , তিনবার ......অজস্রবার__
হয়তো !
তোরঙ্গের চিরকুট সাক্ষী
প্রেমপত্র একবারই  ছিঁড়েছি জীবনে
বন্দুকের নলের তলায় উবু হয়ে বসে ছিঁড়েই
চিনেছি নিজের পাপী চেহারা
কাপুরুষ ! ভীরু !

ওমনি কটা  ক্ষোভ তারা  তোরঙ্গে নেই

তোরঙ্গ বন্ধ  করতেই হৃদয়চেরা  তন্বী তলোয়ারের ফলা
ব্যালে  নাচ  দেখায়
তখন  নিজেরই  শব্দহীন রক্তক্ষরণ দেখে
খুব আরামবোধ হয়
সারা  অঙ্গে ছড়িয়ে  যায় আসে _ আসে _ আসে
নদীর ধারায় লাল রেখা টেনে আনন্দ ও ছাড়
নীল হাঙরের অমন লাল চোখ উপেক্ষায় হঠিয়ে আচমকা তুমি ধরে ফ্যালো হাত

কোন জেদ রাখিনি একা থাকতে চেয়ে
যতই সঙ্গ দিতে চাও, একাই তো।

বোঝা গুলো সব  নেমে গেল একে একে
তখন আমিও পাহাড়ের তলদেশে এসে গেছি
আর  উঠবো  না জেনে তাও দ্যাখো -
আবার চড়াই  চড়ি
উৎরাই এ নামি
এমনিই তো চলে  এসেছে, এমনিই  তো চলে
তুমি থাকলে বা না  থাকলেও
আমি যতদিন  আছি ততদিন  চলায় বা স্বপ্নে
কাল্পনিক জাহাজে
স্পেসক্রাফটে
ডিঙ্গিতে বা
এক কুরসির উড়ন্ত চাকতিতে

এই  একা একা  থাকাটাও
- তুমি থাকলেও -
ছুঁয়ে থাকার মত
সঙ্গ দিচ্ছি এই সন্তুষ্টিতে
আর সেই ছোঁয়ার
স্রোত ধরে ধরে কত ওঠা কত নামা
হাসপাতালের দরজায় অপেক্ষা ও নিষেধের তর্জনিতে
মেলার নাগরদোলার অস্থির উল্লাসে
মন্থর ট্রেনের দুলুনিতে।

তুমি ভেবেছিলে আমি তোমার কাছে আছি
তাই তো চেয়েছিলাম।

তোরঙ্গটা  বন্ধ করলাম

তোমার মুখোমুখি হওয়ায় লজ্জাতেই
স্মৃতিচারণ আমাকে মানায় না 
আমার চলাফেরা
দেহভাষা
কেউ
স্মৃতিকে জায়গা দেয় না

তুমিও এলে জমি দখলের প্রত্যয়েই
আমার সম্বিৎ ছিল
সব কথা
মুখে বলে দিতে হয়না
শূন্যতা নিজেই টেনে নেয় পলিমাটি
পায়ের তলাকার
আস্থা
নীরবতার শব্দহীন গান।

তুমি এর কোন
একটা নও
তুমিই এই সবকটা মিলিয়ে একটা
আবার সবকটাকে সরিয়ে রেখে
শুধুমাত্র তুমি
সেও একটাই
কোন কিছুরই দুটো হয় না
জায়গা থাকলে সবাই এসে যায়
গেড়ে বসে আবার মিলিয়েও
যায় সেটাও
সেই
জায়গার অভাবেই  তো

ভেবে অবাক হই
সবকিছু মেনে নেওয়ার
চলতা  হ্যায় বোঝাপড়া এ
কেলোর  কিত্তি আমরই আত্মজীবনীর  হিসসা।
চিন্তাকে আয় ঘুম যায় ঘুমের ভাঁওতা  দিয়ে পালিয়ে
মধ্যরাত্রের  হুল্লোড়ে  আমিই শামিল
হয়েছিলাম
ভেতরে যত শব্দ ছিল
তার কোন মানে লেখা ছিল না
কোনো ডিকসনারিতে  কিন্তু
চুলবুলে অত নারীপুরুষ
কেউ কি নিজেকে
আবদ্ধ ভেবেছিল
অতো আবর্জনাশব্দে
ওপানীয়দের  মিশ খাওয়া সংকরণে 
দূষণে
শরীরী  মেলামেশায়।

মস্তিষ্কে অতো 
অতিক্রমনের ঘোলাটেপনা
টলায়মান অঙ্গ স্বতঃস্ফূর্ত উনপঞ্চাশ  বাতাস টেনে কুপচিময় ধুমতামাকে চোখের বালি

আবার সুধীজনের আসরে
সুশীলসমাজের দায়বদ্ধতায়
নিজেকে লুকিয়েছি  যথাযথ  জামাকাপড়ে
তারও কতো  বহুরূপী বাহার
চিন্তার জারকে  শোধন করা
রকমারি কুর্তা শার্ট কোটের প্রতীপে
পাজামা -জিনস -ট্রাওজারের জটিল রচনায়
কেউ জানেনা  ভেতরে ভেতরে কত চলতে থাকে নদী ও সময়ের কোলে
পারাপারের মতলব আঁটাআঁটি
এরাও  তো আত্মজীবনীর অতি আবশ্যিক উপকরণ
কত পুঁথি পাঠ হলো আত্মজীবনীর নামে 
কতো বন্ধুত্বের ড্রয়িংরুম সাহিত্য আড্ডা
আত্ম প্রচার করে বেড়ানোর 
বিবিধতা সত্ত্বেও এত পুনরাবৃত্তি
যে কান পচে গেছে



বাণপ্রস্থে  যাবার  সময়কালে
সম্পত্তি ভাগাভাগির  ব্যাপারটা 
একটা নাটকহীন প্রস্তাবনাহীন অবস্থায়
ক্রিয়াপদের পা বাদ দেওয়া  যেন বা
রাত্রিবাসের প্যাঁটরা হাতে বেরিয়ে পড়ার মত।

জুড়িয়ে  আসা  কথারা ঘুমিয়ে পড়লে
তাদের না জাগিয়ে বা
জাগানোর স্পৃহাকে  লাগাম দিয়ে
রাস্তাটা আঁচ করে নেওয়া  বারবার

নতুন-কখনই-নয় রাস্তারা
কাঁকরে
গুল্মে
ভেষজগন্ধে
টেনে নিয়ে যেতে থাকে

আশ্বাসগুলোয়
হতে পারে নতুন বলে কিছু হয় না
কিন্তু আমি যদি
দেখেও না দেখি।

ততদিনে সংসার বলতে তলানি কিছু থাকলেও সেটা রান্নাঘরের স্খলিত
বাসনদের ঝিঙ্কার
বিরক্তি কিম্বা প্রতিবাদের মাও নয়
লকারের বহুমূল্য
গাম্ভীর্যও নয়
তোমাকে কিছু বলে যেতে চাই নি
সংস্কারের জং লাগা
জাহাজ কিনব না বা ভাড়াও
করবো না মৃত্যুর সাজগোজ
মৃত্যুর জাহাজ দেখতেও যাবো না কোন
গুরুগিরির  আখাড়ায় ওটার দরকার
পড়ে না  বলেই
মৃত্যু সে এমনই স্বতোৎসৃষ্ট 
সে সময়ের মতোই 
অবয়বহীন নিরপেক্ষ

                      শরীর যতক্ষণ আছে  ততক্ষণ         ক্ষিদে তেষ্টা  আছে
                      মন যতক্ষণ  আছে  ততক্ষণ  চাওয়া পাওয়া আছে
                       ইন্দ্রিয়েরা  যতক্ষণ  আছে  ততক্ষণ  সাড়া  আছে
                         বোধ যতক্ষণ  আছে  ততক্ষণ  আলো আছে
কবিতাও আছে
ছবিও  আছে 
গান ও  আছে

ওগুলোতে  আয়না  নেই
তোরঙ্গ নেই
জল বাতাস নেই
কিংবা ওগুলো নিহিত  আছে
সমস্তই
সম্পূর্ণ  ভুবন
যেটা  ঠিক আমার মাপের   আমার পছন্দের
যেটা আমার
যাবতীয় চাহিদা  মেটানোর উপায়
তাতেই নিহিত

আমার এই অবধারিত বন বাস
এ আমার পূর্ব নির্ধারিত ললাটলিখন 
তুমিও।

আসলে কোথাও  যাই না
থাকিনা  কোন  স্থাণু কুঠুরিতে
ট্রেনের মতো কামরাগুলো
চলন্ত
ওটা সময়
আর সর্বক্ষণ আমি তার  সঙ্গে
ওর  মতই
অবিরাম, নিরবধি
এই  আমি 
সেখানে আরম্ভ বা শেষ কেনই বা দেখতে যাবো

তোমার শীর্ণ চেহারা  আমাকে নিরস্ত করে  না কখনো  যদি ঐ  বোঝা
নিয়ে পাহাড় ডিঙোতে হয় তাও , সেটাও আমার ধরে রাখা আছে , এটা
কি সঙ্গে থাকার মাশুল না এটাকেই আমি সময় বলছি
সময় যার এক সেকেন্ড  আর এক  সেকেন্ডের  সমান সমান না
কোনটা বিদ্যুৎ  
পলক  ফেলার অবসর  দেয় না 
কোনটা  ঢিমে, চলেই না।

যে  সময়টা চলতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে যেটা 
ঘড়ির কাঁটা নয় জলের স্রোতও নয়
তার ভেতরকার তারতম্য সর্বক্ষণ ওঠায় 
নামায়
ফুরিয়ে যাওয়ায় 
সৃজনে
মাঝনদীর  খরস্রোত বা বা
মাঝ মরুভূমির খরা
বালিয়াড়ি 
কেউই যথেষ্ট  বাধা দেয় না চলায়
চলতে থাকে বিশ্বজগৎ
চলতে  থাকি সঙ্গে

বনবাসে  যাওয়ার কোজাগরী রাত  নয়
শাণিত  পরম্পরার  শিকার যাত্রা  নয়
যে প্রস্তুতি থাকবে
জের টানা ব্যস্তসমস্ততার
আর  তটস্থ সৈন্যসজ্জা
একান্ত মন্থনে আরোপ করতে চাইবে শৃঙ্খলা
আলতো পায়ে  চৌকাঠ পেরোন
চৌহদ্দি  ডিঙ্গোন
উজাড় গ্রামের ঘুম ডিঙ্গিয়ে
সন্তর্পণে
পায়ে পায়ে চলে আসে বালি
কাঁকর ক্বচিৎ  নুড়ি ও
শুকনো পাতাদের
করুণ খর্খর আর
তার হাত ধরে ধরে প্রাচীন ভয়গুলি 
বেঁচে  থাকার আকুতিতে
গুল্মদের সবুজ জমির ঘাসে লেপ্টে থাকা শঙ্খপুষ্পী, কুকশিমা, দ্রোণ
ঘাসের আড়ালে পোকাদের ঘরকন্না
পাখিদের দিনচর্যার কাটুম কুটুম

পথচলা।

প্রাক্কালের একান্ত চেনা  বিদায় চিহ্নেরা 
বাঁধাবাঁধি
সব উপেক্ষার  খাতায় চলে যায়
চলার আবেগে 
পায়ে  বাঁধা বাউল নাচের ঘুঙুর 
আর পথ চলে আসে উত্তুঙ্গ ফ্ল্যাটের মাঝ উঠোনে হুশ উঠে যাওয়া লিফটকে  পাত্তা না দিয়েই
এই  না  উঠোন  না ঘরের জীবনশৈলী
ছাত ও দেয়ালের রক্ষণশীল আস্থা
ভালো লাগার  ক্ষণস্থায়ী খেয়ালকে একটুক ধরে আবার  ছাড়ে
পিছুটানে প্রবলতা অকেজো হয়ে
চুম্বকে জং ধরায়
হার্ড ডিস্কে জায়গা বাড়িয়ে চললেও
ফিরে আসার রাস্তাগুলো হড়পে  নেয় জনবিস্ফোরণের মতই
জনবিস্ফোরণের  সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসা বানভাসি অধিকারবোধ ও দখল

এর একটাও এগিয়ে যাওয়া  নয়
পিছিয়ে আসাও নয়
বাসার প্রস্তাবনায় নিহিত বোঝারা দ্যাখো 
কাঁধের ওপর থেকে বিলীন
একেবারে কোন শব্দ না  তুলেই

চড়া  রোদ উঠবে কড়া  শীত নামবে
কুয়াসার জলকণারা ভিজিয়ে দেবে
আবহাওয়ার ফুরফুরে  অনায়াস ছটফটেপনা
ফুলন্ত ধানক্ষেতের  ভুবন জোড়া সুঘ্রাণে
প্রচ্ছন্ন  ফলনের, ফসলের, আশ্বাসে
উৎসবের ছোঁয়া  লাগা মন যখন পরিপূর্ণ
তখনই  কোজাগরী
তখনই বেরিয়ে পড়া
এ প্রস্তাবে কোথাও  ফেরার কথা  নেই

শরীর থাকলে ক্ষিদেতেষ্টা থাকলে  মুক্তি খোঁজার এই দোগলা চিন্তার শেকল
খুলে নিজেকে  আলগা  করে  নিয়ে এবার তোমার কথা
ওখানটা কখনই খালি নয়
ক্ষিদেতেষ্টার  জায়গাটাও খালি নয়
শীতগ্রীষ্মের কামড়
বর্ষাকালীন আর্দ্র ছোঁয়াচফোবিয়া 
টেনে রাখবে মাটিতে

পলায়ন  নয়

একটা  অবস্থা
আর একটা অবস্থায় বিলীন না হলে বুঝবে না

No comments:

Post a Comment

সূচীপত্র

সম্পাদকীয় দেহ্‌লিজের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ হলো অনুবাদ Agni Roy ...