Sunday, May 19, 2019

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




কিস্সা কহানী কী...

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়



ছবিটার দিকে দেখলেই এখন খুব মন খারাপ হয়ে যায় শাহজাদীর। ছবিটা দেখতে ইচ্ছে না করলেও বারবার তাঁকে টানে। উনিশ শতকের কোনও এক মাঝামাঝি সময়ে নন্দলাল বসু এঁকেছিলেন ছবিটা । ওই ছবির যৌবন আর সৌন্দর্য , নিজেকে ভুলে যাওয়ার মুহূর্তে দুই চোখ যেমন দিশাহীন নৌকোর মত ভেসে থাকে মাঝনদীতে , অমন দৃষ্টি আর কখনও ফিরে পাবেন না তিনি। ছবিটার দিকে এক সময় তাকিয়ে কল্পনায় ভেসে চলেছিল তাঁর কথন –কাথন। শুধু ঐ ছবির দিকেই চেয়ে তিনি ঘন্টা প্রহর মাস বছর গল্প বুনে যেতে পারতেন এক সময়। দিন রাত্রির হুঁশ জ্ঞান থাকত না। শাহজাদীর গল্প শুনে বেবাক সময় কাবার করে ফেলতেন সুলতান। হয়ত তখন ঐ ছবিটার দিকে তাকিয়েই শাহাজাদী ভেবেছিলেন , সুলতানকে বলা হাজার এক রজনীর গল্প গুলোর মতই তিনি নিজেও চির নবীনা থাকবেন। এখন শাহাজাদী আর আগের মতন নেই। তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন । চামড়া ঝুলে গেছে, চুল সব সাদা, চোখের দৃষ্টিও বেশ ক্ষীণ। একটু বেশি কথা বললেই হাঁপ ধরে যায়। নন্দলাল বসুর আঁকা ছবিটা তিনি মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর ভাবছিলেন কবে তিনি এই ছবির দিকে চেয়ে সুলতান কে তাঁর শেষতম দাস্তানটি শুনিয়েছিলেন । কিন্তু কিছুতেই দাস্তানটি মনে পড়ে না। শুধু তাই নয়, সুলতান কে শোনানো কোনও গল্পই আর তার মনে নেই। গল্পরা যেমন ভেসে যায় , মানুষও কালস্রোতে ভাসতে ভাসতে পুরনো হয়ে যায়। মনে মনে ভাবলেন তিনি , এখন আমি গল্পের মতই ভেসে গেছি। অথচ ছবির সৌন্দর্য কালস্রোতকে থমকে দিয়ে চলে গেছে । দুনিয়াদারীর সমস্ত নিয়ম কানুন এখানে তুচ্ছ।

খোজা প্রহরী এসে সুলতানের আসার খবর দিয়ে গেল । কিছুক্ষণ পর সুলতান এসে মহলে পৌঁছলেন। তাঁর শরীরে আপেল খোবানির খুশবু। হেসে বললেন , ছবির সামনে বসে কি করছ বেগম সাহেবা? গল্প খুঁজছি জাঁহাপনা। গল্প?- অবাক হলেন সুলতান। তারপর গালিচায় বিবির পাশে বসে নিচু হয়ে ছবির দিকে তাকালেন।


শাহজাদী উদাস মুখে বললেন, আপনি আর ওখানে কোনও গল্পই দেখতে পাবেন না জাঁহাপনা। ঐ ছবি থেকে গল্প অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। শুনে সুলতান হাসলেন। বললেন , বিবিজান আজ রাতেই আমি তোমার মুখ থেকে  সেই আগের মত কাহানী শুনতে চাই। তুমি বলবে আর আমি শুনব। আমি তো সব গল্প কবেই ভুলে গেছি জাঁহাপনা। আর কাহানী বলতে পারি না। তাছাড়া বুড়ো হয়ে গেছি, ভাল করে একটানা গল্প বলতেও অনেক কষ্ট। হ্যাঁ বুড়ো তুমি হয়েছ এ কথা সত্যি বটে কিন্তু তোমার বলা কহানী বরাবর কিছু অন্য জিনিষ শোনায়। আমি তোমার সেই মনো মুগ্ধকর কাহানীই আজ রাতে ফের শুনতে চাই শাহজাদী। হ্যাঁ ছোটবেলা থেকে কিসসা কহানীর মধ্যেই আমি বেঁচে থেকেছি। অনেক অনেক কিতাব পড়েছি। অনেক অনেক কাহানী শুনেছি। খেতে বসে, ঘুমনোর সময় খেলুড়েদের সঙ্গে খেলবার সময়ও আমি কহানী নিয়ে ভেবেছি...। সুলতান দেখলেন পুরনো ধুলো পড়া ছবিটার দিকে এক মনে চেয়ে শাহাজাদী নিজের মনে কথা বলে চলেছেন। বলতে বলতে শাহজাদী কখনও উদাস হয়ে যাচ্ছেন , কখনও চোখে জল ভর্তি হয়ে উঠছে। এসবই বুড়ো হবার লক্ষণ। সুলতান নিজেও বেশ বুড়ো হয়েছেন । তাঁর রাজত্বের অনেকানেক কাজকর্ম  পারিষদদল দেখাশোনা করে। কিতাব খানায় তাঁর কয়েক হাজার কিতাব –দাস্তান রক্ষিত আছে। প্রাচীন সব জাতি, মহারাজ- সম্রাটদের সম্পর্কিত রাজত্বের ধারা বিবরণী ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন । তাছাড়া দর্শন বিজ্ঞান কবিতার কিতাবও তিনি বাদ দেন নি...। কিন্তু লাভ কি হল? সবই তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে মীর তকী মীরের একটা শের মনে আসছিল তাঁর, কিন্তু পুরো শেরটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। সে যে কি কষ্ট! চেনা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষটার নাম মনে করতে না পারার মতই। দুদিন পর আস্তাবল থেকে ভেসে আসা ঘোড়ার চিৎকারে মনে পড়ে গেল দাগ-ই-ফিরাক-ও-ইরসত-ই-আসল্, আরজু-ই-শওক ম্যাঁয় সাত জির-ই-খাক থি হাঙ্গাম লে গয়া।


বিচ্ছেদ বেদনা, আশিকের জন্য আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসার পিপাসা - একটা এই ঝড় নিয়ে আমি কবরে চলে গেলাম। সুলতান দেখলেন শাহাজাদী ছবির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ। সব কথা তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না, নিজের মনেই বলতে হয়। তাই শাহাজাদীকে বললেন ,

বিবিজান ওঠো। চলো কিতাব খানায় গিয়ে দুজনে বসি।

কেন?

তুমি যে বললে তুমি সব কাহানী ভুলে গেছ। কিতাব খানায় বসলে কিছু কাহানী তো তোমার মনে পড়তেও পারে।- সুলতানের কণ্ঠস্বর বেদনাহত। তিনি অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটুতে যন্ত্রণা হচ্ছে। শাহাজাদী তাঁর হাতে হাত রেখে বললেন , নতুন কিসসা যদি বলি, তোমার শুনতে ভাল লাগবে না। সঙ্গে সঙ্গে সুলতান হাসলেন। এর মধ্যেই নতুন কিসসা বানিয়ে ফেললে বুঝি?

কিসসা কি কেউ বানায় সুলতান? চারপাশে সব সময় তাদের জন্ম হচ্ছে, তারা মরে যাচ্ছে। মানুষ শুধু তার নিজের পছন্দ মত কিসসা বেছে নেয়। কিন্তু এসব কথা শাহাজাদী উচ্চারণ করলেন না। কথা পুরুষ তাঁকে বলেছেন যে , যে রহস্য কিনারা থেকে কিসসারা জন্মায় তা নিয়ে কখনও কথা বলতে যেও না। হাজার হাজার বছর ধরে কিসসারা বেঁচে থাকে রহস্যের ঝরনার জলপান করে। কিতাব খানার মেঝেয় পাতা ফরাসে এসে বসলেন দুজন। চামড়ায় বাঁধানো হাজার হাজার বই। সোনার জলে নাম লেখা। বই গুলোর দিকে তাকিয়ে শাহাজাদীর মনে পড়ল জেগে থাকা আর স্বপ্ন দেখা আসলে একই বই এর পৃষ্ঠা। ধারাবাহিক ভাবে পড়ার নাম বেঁচে থাকা, আর পৃষ্ঠা উলটে পালটে এলোমেলো পড়ার নাম স্বপ্ন দেখা। কথাটা কে বলেছিলেন শাহজাদী মনে করতে পারলেন না। সত্য অনুভবের কোনও লেখক থাকে না। শুধু কলম চালনার শব্দ শোনা যায়। হঠাৎ শাহজাদী শুনতে পেলেন কোথায় বাড়ি ভেঙে পড়ছে। আকাশ থেকে পড়া বোমার আঘাতে মিনিট খানেকের মধ্যেই বাড়িটা হুড়মুড়য়ে ভেঙে পড়ছে। বাড়ির লোকদের মত বাড়িটাও এই মাত্র মরে গেল। বাড়ির প্রত্যেক কোনায় আঙুলের স্পর্শ। সিমেন্ট ইট কাঠের পোড়া টুকরো গুলো মানুষের ছেঁড়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গর মতই যন্ত্রণায় কাঁপছে।

চুপ কেন বিবিজান? কহানী শুরু করো-

শাহজাদী বললেন , সমুদ্রের তীরে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে তিন বছরের ছেলেটি। লাল জামা , নীল প্যান্ট, পায়ে জুতো। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সে। মাঝে মাঝে সমুদ্র এসে তাকে আদর করে যাচ্ছে।

কে ছেলেটি?- প্রশ্ন করলেন সুলতান।

আয়লান কুর্তি। দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাবা মায়ের সঙ্গেই ঘরের খোঁজে বেরিয়েছিল। তুরস্কের সমুদ্র তীরে এই ভাবেই ওর মৃতদেহ পাওয়া গেছিল।

কোন দেশ থেকে এসেছিল?

সিরিয়া। ওই দেশটা এখন আর মানচিত্রে নেই। একের পর এক ভয়াবহ যুদ্ধে কবেই হারিয়ে গেছে।

শাহজাদী একটা কিতাব খুলে একটা ছবি সুলতানের সামনে তুলে ধরেন। দেখুন জাঁহাপনা। সুলতান দেখলেন আর একটি বছর পাঁচেকের শিশু। শিশুটির সারা মুখ ছাইয়ে ধূলি মলিন। শরীরে ছেঁড়া ফাটা নোংরা পোশাক। মুখের বাঁদিক রক্তাক্ত। বাচ্চাটির ছবির দিকে তাকিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন সুলতান।

 কে এই বাচ্চাটি? এত সুন্দর ছেলেকে কে মারল?

ওমরাহ দানিশ। - নিঃস্পৃহ কণ্ঠে উত্তর দিলেন শাহজাদী। - সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে ওরা থাকত।

অধীর হয়ে সুলতান বলে ওঠেন , তুমি কি সব গল্পই ভুলে গেছ বেগম সাহেবা? কি বলছ এসব? হাজার এক রাত্রির সেই সব সিন্দাবাদ, হারুন অল রশিদ, আলিবাবা, আলাদীন এদের কাহানী বলো ...এসব কি ?

শাহাওরজাদী বিড়বিড় করে বলে চললেন, সেদিন সন্ধ্যায় কাররজি এলাকায় মসজিদে সবে আজানের ডাক দেওয়া হয়েছে, ঠিক এমনি সময় সাইরেনের শব্দ।


ওই সাইরেনের শব্দ শুনতে শুনতেই তো ওমরানের বড় হয়ে ওঠা। এমন সময় একটা বোমা এসে পড়ল ওমরানের বাড়ির মাথায়। নিমেষে চারপাশ অন্ধকার, সব ধ্বংসস্তূপ।

না বিবিজান। এই সব কিসসা আমি কিছুতেই শুনব না। অতীত দিনের মত সেই সব সুন্দর সুন্দর কিসসা তুমি শোনাও। শাহজাদী এবার করুণ হাসি হাসলেন। বেদনা ও ঠাট্টা মিলেমিশে গেছে তাঁর হাসিতে। আস্তে আস্তে সুলতান কে বললেন, আপনি যা শুনতে চাইছেন সেই সব গল্প দের ভেতর আমিও এতদিন বেঁচে ছিলাম জাঁহাপনা। ওই কিসসারা এখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে । আমার তাই মৃত্যু হয়েছে। এখন আমি শুধু এই সব কাহানীই জানি।

No comments:

Post a Comment

সূচীপত্র

সম্পাদকীয় দেহ্‌লিজের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ হলো অনুবাদ Agni Roy ...